ইরান কেন মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিল আসাদের থেকে


ইরান এবং সিরিয়ার সম্পর্ক মধ্যপ্রাচ্যের অন্যতম দীর্ঘস্থায়ী এবং গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক জোটগুলোর একটি। বিশেষ করে বাশার আল-আসাদের শাসনামলে এই সম্পর্ক শক্তিশালী ছিল। তবে, সময়ে সময়ে ইরানকেও আসাদের প্রতি সমর্থনে সংযমী হতে দেখা গেছে। কেন ইরান আসাদের থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিল? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে হলে ঐতিহাসিক, রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক বিভিন্ন দিক বিশ্লেষণ করতে হবে।

ইরান-সিরিয়া সম্পর্কের ঐতিহাসিক পটভূমি।

ইরান ও সিরিয়ার কূটনৈতিক সম্পর্কের গোড়াপত্তন ঘটে ১৯৮০-এর দশকে, ইরান-ইরাক যুদ্ধের সময়। ইরাকের বিরুদ্ধে ইরানের যুদ্ধে যখন বেশিরভাগ আরব রাষ্ট্র সাদ্দাম হুসেইনের পক্ষে দাঁড়ায়, তখন সিরিয়া ইরানের পাশে দাঁড়ায়। এ সময় সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট ছিলেন হাফেজ আল-আসাদ, বাশার আল-আসাদের বাবা।

সেক্যুলার আরব জাতীয়তাবাদী সিরিয়া এবং ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের মধ্যকার আদর্শগত পার্থক্য সত্ত্বেও, উভয় রাষ্ট্র ইরাক ও পশ্চিমা প্রভাবের বিরুদ্ধে এক হয়ে যায়। সিরিয়া ছিল ইরানের জন্য একটি কৌশলগত পথ, যার মাধ্যমে তারা লেবাননের হিজবুল্লাহকে সমর্থন দিতে পারত। এই বাস্তবসম্মত কৌশলগত সম্পর্কই ইরান-সিরিয়া মৈত্রীর মূল ভিত্তি তৈরি করে।

সিরিয়ার গৃহযুদ্ধ: সম্পর্কের বাঁকবদল।

২০১১ সালে সিরিয়ায় শুরু হওয়া গৃহযুদ্ধ ইরান-সিরিয়া সম্পর্কের নতুন অধ্যায়ের সূচনা করে। যখন বাশার আল-আসাদের বিরুদ্ধে জনবিক্ষোভ যুদ্ধের রূপ নেয়, তখন ইরান তার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মিত্র হয়ে ওঠে। ইরান সামরিক উপদেষ্টা, আর্থিক সহায়তা এবং হিজবুল্লাহসহ অন্যান্য মিত্র গোষ্ঠীগুলোর মাধ্যমে সিরিয়াকে সহায়তা করে।

এই সহায়তার মূল কারণ ছিল সিরিয়াকে “প্রতিরোধের অক্ষ” বা “অ্যাক্সিস অফ রেজিস্ট্যান্স”-এর অংশ হিসেবে ধরে রাখা। সিরিয়া হারালে ইরানের আঞ্চলিক প্রভাব হ্রাস পেত এবং ইসরায়েলের বিরুদ্ধে লড়াই করার ক্ষমতাও দুর্বল হয়ে পড়ত।

কিন্তু, যুদ্ধ যত দীর্ঘায়িত হতে থাকে, ইরানের জন্য এর খরচও বাড়তে থাকে। গৃহযুদ্ধের কারণে ইরানের অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং আন্তর্জাতিক সমালোচনার মুখে পড়ে। তখন থেকেই ইরান ধীরে ধীরে আসাদের প্রতি তাদের সমর্থনে কিছুটা সতর্কতা অবলম্বন শুরু করে।

ইরান কেন আসাদের থেকে দূরে সরে যেতে বাধ্য হয়েছিল?

১. অর্থনৈতিক চাপ।

ইরান দীর্ঘদিন ধরে কঠোর আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞার মুখে রয়েছে, বিশেষ করে তাদের পরমাণু কর্মসূচির কারণে। সিরিয়াকে সমর্থন দিতে ইরানকে বিপুল অঙ্কের অর্থ, জ্বালানি এবং সামরিক সরঞ্জাম সরবরাহ করতে হয়েছে। দীর্ঘমেয়াদে এই খরচ বহন করা ইরানের পক্ষে কঠিন হয়ে পড়ে।

২. রাশিয়ার সঙ্গে মতপার্থক্য।

২০১৫ সালে রাশিয়া সিরিয়ার যুদ্ধে সরাসরি সামরিক হস্তক্ষেপ শুরু করলে যুদ্ধের গতিপ্রকৃতি পাল্টে যায়। যদিও রাশিয়া এবং ইরান উভয়ই আসাদ সরকারকে সমর্থন করছিল, তাদের কৌশলগত লক্ষ্যগুলো সবসময় এক ছিল না।

রাশিয়া চেয়েছিল সিরিয়ার রাষ্ট্র কাঠামোকে সংরক্ষণ করে নিজের প্রভাব বিস্তার করতে, যেখানে ইরান চেয়েছিল তার প্রভাবশালী সামরিক উপস্থিতি বজায় রাখতে। রাশিয়ার মধ্যস্থতায় হওয়া বিভিন্ন চুক্তিতে ইরানকে প্রায়শই উপেক্ষা করা হয়, যা সম্পর্কের টানাপোড়েন সৃষ্টি করে।

৩. আসাদের নিজস্ব রাজনৈতিক পদক্ষেপ।

যদিও আসাদ ইরানের বড় মিত্র, তিনিও সবসময় ইরানের প্রভাব মেনে নেননি। বিভিন্ন সময়ে সিরিয়ার অভ্যন্তরে ইরান-সমর্থিত গোষ্ঠীগুলোর কার্যক্রম নিয়ে আসাদের আপত্তি দেখা গেছে। বিশেষ করে হিজবুল্লাহর ভূমিকা নিয়ে সিরিয়ার সেনাবাহিনীর সঙ্গে দ্বন্দ্ব দেখা দেয়।

আসাদ রাশিয়ার দিকে ঝুঁকতে শুরু করলে ইরানের প্রভাব কিছুটা কমে যায় এবং সিরিয়ায় তেহরানের কৌশলগত অবস্থান দুর্বল হতে থাকে।

৪. আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক চাপ।

ইরানের সিরিয়ায় উপস্থিতি নিয়ে প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলোও ক্রমাগত অসন্তুষ্ট ছিল। ইসরায়েল নিয়মিত ইরান-সমর্থিত ঘাঁটিগুলিতে বিমান হামলা চালিয়ে তাদের অবস্থান দুর্বল করার চেষ্টা করেছে।

অন্যদিকে, সৌদি আরব এবং তুরস্কের মতো আঞ্চলিক শক্তিগুলোও সিরিয়ায় ইরানের উপস্থিতিকে প্রতিদ্বন্দ্বী হুমকি হিসেবে দেখেছে।

১. আর্থিক সহায়তা কমানো।

২০১৮-এর পর থেকে সিরিয়াকে ইরানের আর্থিক সহায়তা কমতে শুরু করে। তেহরান তার দেশের অভ্যন্তরীণ অর্থনৈতিক সংকট এবং আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞার কারণে সিরিয়ায় বিনিয়োগ কমিয়ে দেয়।

২. সামরিক কৌশল পরিবর্তন।

ইরান সিরিয়ার গোটা ভূখণ্ডে উপস্থিত থাকার পরিবর্তে নির্দিষ্ট এলাকায় নিজেদের প্রভাব সীমাবদ্ধ করে। তারা দক্ষিণ সিরিয়া এবং দামেস্কের কিছু অংশে নিজেদের অবস্থান মজবুত করে।

 

৩. প্রক্সি বাহিনীর ওপর নির্ভরতা বাড়ানো।

সিরিয়ার সেনাবাহিনীর ওপর নির্ভর করার বদলে ইরান হিজবুল্লাহ ও অন্যান্য মিত্র মিলিশিয়া গোষ্ঠীগুলোর শক্তি বাড়াতে মনোযোগ দেয়। এটি কৌশলগতভাবে তাদের উপস্থিতি টিকিয়ে রাখার একটি পন্থা ছিল।

সমাপ্তি

ইরান-সিরিয়া সম্পর্ক কেবল আদর্শিক বন্ধুত্ব নয়; এটি কৌশলগত স্বার্থে তৈরি একটি জোট। সময়ের সাথে সাথে মধ্যপ্রাচ্যের ভূরাজনীতি পরিবর্তনের ফলে এই জোটও নানা টানাপোড়েনের মধ্য দিয়ে গেছে। অর্থনৈতিক সংকট, আঞ্চলিক চ্যালেঞ্জ, এবং আসাদ সরকারের নিজস্ব রাজনৈতিক পদক্ষেপ ইরানকে মাঝে মাঝে সিরিয়ার প্রতি সমর্থনে সংযমী হতে বাধ্য করেছে।

তবে, ইরানের কৌশলগত প্রভাব বজায় রাখতে সিরিয়া এখনও গুরুত্বপূর্ণ। তাই, সাময়িক দূরত্ব সৃষ্টি হলেও ইরান-সিরিয়া সম্পর্ক এখনও টিকে আছে এবং ভবিষ্যতেও তাদের কৌশলগত প্রয়োজনে এই সম্পর্কের ধরন বদলাতে পারে।

Rate this post

আসসালামু আলাইকুম, আমি মো: খালিদ শেখ, পেশায় একজন চাকুরীজীবি এবং এই ওয়েবসাইট এর এডমিন, আমরা যেহেতু লেখালেখি করি সেক্ষেত্রে অনেক সময় ভুল হতে পারে। যদি কোন ভুল হয়ে থাকে অবশ্যই ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।

Leave a Comment